জামিল শেরাটন হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে আছে।
দুপুর তিনটা বাজছে। জামিল অপেক্ষা করছে লন্ডন ফিল্ম একাডেমীর গবেষক ইলেনোরা পডরেকার জন্য। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উপর একটা ডকুমেন্টারি তৈরী করার জন্য ইলেনোরা বাংলাদেশে এসেছে। জামিল যেই এ্যাড ফার্মের জন্য কাজ করে, তারা এই ডকুমেন্টারি তৈরীর কাজে ইলেনোরাকে সাহায্য করার জন্য ওকে পাঠিয়েছে। আজকে সকাল থেকে জামিল ইলেনোরার সাথে শহীদ মিনার আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে প্রায় চার ঘন্টা ঘুরেছে, আর ইলেনোরাকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছে। ইলেনোরা কিছু ফুটেজ নিয়েছে, আর কিছু ভিডিও ইন্টারভিউ করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে খুব তৈরী হয়েই এসেছে। ইলেনোরা ভাষাতত্ত্বের ছাত্রী ছিলো ... প্রায় আটটা ভাষায় সমান দখল নিয়ে কথা বলতে পারে। বাংলা তার মধ্যে একটা। এতে জামিলের সবচেয়ে বেশী সুবিধা হয়েছে। চার ঘন্টা ধরে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানোর মতো অবস্হা জামিলের না।
এই মুহূর্তে জামিল অপেক্ষা করছে আজকের দিনের পরবর্তী সেশনের জন্য। ইলেনোরা তার রুমে। জামিলকে নীচে অপেক্ষা করতে বলে গেছে। আরও বলেছে কালকে একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে শহীদ মিনারের একটা ফুটেজ নিবে। এরপর দুপুর একটার ফ্লাইটে সে কোলকাতা চলে যাবে। ওখানেও তার এই ডকুমেন্টারির কিছু কাজ আছে। জামিলের মনে হচ্ছে ইলেনোরা প্রচন্ড আবেগ নিয়ে এই ডকুমেন্টারিটা তৈরী করছে। সকাল থেকে অনেক উত্সাহ নিয়ে সে একটার পর একটা ইন্টারভিউ করছিলো। কাজের ফাঁকে জামিলের সাথে খুব আগ্রহ নিয়ে এসব ব্যাপারে কথাও বলছিলো। একটু পরপর বলছিলো, তোমাদের ভাষার ইতিহাস এতো গৌরবের! এটাতো তোমাদের অনেক বড় সৌভাগ্য।
এসব ব্যাপার নিয়ে জামিল অবশ্য এখন আর তেমন কোনো আবেগ অনুভব করে না। একুশে ফেব্রুয়ারির উপর তৈরী করা অনেক ডকুমেন্টারি ও আগেও দেখেছে। আজকে জামিল এসেছে অন্য একটা কারণে। বিএসসি পাস করার পর প্রায় একবছর ধরে জামিল বেকার অবস্হায় আছে। এ্যাড ফার্মটাতে ওর কোনো চাকরী হয়নি, তবে মাঝেমাঝে ওরা টুকটাক কাজ দেয়। ফার্মের মালিক আসমা আপা জামিলকে খুব স্নেহ করেন। তিনি গত পরশুদিন জামিলকে ইলেনোরার ডকুমেন্টারির কথাটা বললেন। তার সাথে আরও বললেন, তুমি যদি এখন ওকে একটু হেল্প করো, তোমার জন্য লন্ডনে গিয়ে ফিল্মমেকিং-এর কাজ শেখার একটা ভালো সুযোগ তৈরী হতে পারে। ইলেনোরা এখন বাংলাদেশের ইতিহাসের উপর ডকুমেন্টারি তৈরী করার জন্য রিসার্চ এসিসটেন্ট খুঁজছে। তুমি যদি তোমার কাজ দিয়ে ওকে ইমপ্রেস করতে পারো, ও তোমাকে সেই এসিসটেন্টশীপের জন্য রেকমেন্ড করবে। ও রেকমেন্ড করলেই তুমি লন্ডন ফিল্ম একাডেমীতে ট্রেনিং-এর জন্য যেতে পারবে। আমার মনে হয় এটা তোমার জন্য খুব ভালো একটা প্রসপেক্ট।
আজকে জামিল সেই প্রসপেক্টের কারণেই এসেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির সেন্টিমেন্ট নিয়ে জামিলের খুব একটা ভাবনাচিন্তা নেই। এসব ব্যাপার এখন একটা রিচুয়ালে পরিণত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই বিশেষ কলাম, বিশেষ ফিচার, বইমেলার ছুটাছুটি, আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পান্জাবি আর সাদাকালো শাড়িতে বাঙালী সাজ ... এরপর মার্চ আসলে স্বাধীনতা দিবসের রিচুয়াল, এপ্রিলে পহেলা বৈশাখের রিচুয়াল, ইত্যাদি। এখন আর এসব আবেগ জামিলকে স্পর্শ করে না। জামিলের সামনে এখন অনেকগুলো বাস্তব সমস্যা। সেসব অনেক সমস্যার সমাধান হবে যদি ইলেনোরার রেকমেন্ডেশনটা পাওয়া যায়। আসমা আপার কথায় মনে হচ্ছে যে এই রেকমেন্ডেশনটা পেলেই লন্ডনে যাওয়া যাবে। একবার সেখানে যেতে পারলে এর পরে কি হবে সেটা পরে দেখা যাবে। এই মুহূর্তে জামিলের বাংলাদেশ থেকে পালানো প্রয়োজন।
লিফ্ট থেকে ইলেনোরা বের হচ্ছে। ওর পরণে সাদা রঙের ফতুয়া, কাঁধে ঝোলানো ভিডিও ক্যামেরা, আর হাতে একটা ফাইল ফোল্ডার। চুল খোলা, খুব সম্ভবত গোসল সেরে এসেছে। ইতালীয়ান অরিজিনের বৃটিশ, পয়ত্রিশের বেশী বয়স হবে না ... লম্বা একহারা গড়ন। জামিলের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত ভঙ্গিতে হাসলো। এরপর কাছে এসে বললো, আমি ফ্রেশ হয়ে এলাম, কিন্তু তোমার এখন সেই উপায় নেই। সরি।
জামিল হেসে বললো, সরি বলতে হবে না। আমাদের কি আজকের কাজ শেষ ?
- না ... তোমার সাথে আমার কিছু আলাপ আছে ... আমার রিসার্চের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। আমি কি তোমাকে ভিডিও ইন্টারভিউ করতে পারি ?
- তাতে যদি তোমার রিসার্চের কোনো সুবিধা হয়, অবশ্যই করতে পারো।
- তাহলে চলো আমরা লান্চ করতে করতে তোমার ইন্টারভিউটা করে ফেলি।
শেরাটনের যেই রেস্টুরেন্টে ওরা ঢুকলো সেটাতে বুফে লান্চের ব্যস্ততা প্রায় শেষের দিকে। এখনও প্রচুর খাবার আছে। জামিলের ক্ষিদে লেগেছে, কিন্তু ইলেনোরার সামনে প্লেটভর্তি করে খাবার নিতে সঙ্কোচবোধ হচ্ছে। ইলেনোরার খাবার নেয়ার ভঙ্গি অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। টেবিলে বসেই ইলেনোরা বললো, তুমি এতো কম খাবার নিলে কেন ?
- আমি দুপুরে একটু কম খাই ... এখন বলো, তুমি কি নিয়ে আলাপ করতে চাও।
ইলেনোরা ভিডিও ক্যামেরাটা স্ট্যান্ডে রেখে জামিলের দিকে ফোকাস করলো। এরপর খাবার মুখে দিয়ে বললো, তোমার কিছু মতামত আমার রিসার্চে খুব কাজে আসবে। আর তোমার এই ইনপুট তোমার রেকমেন্ডেশনের জন্যও ইম্পর্টেন্ট। আসমা কি তোমাকে রেকমেন্ডেশনের ব্যাপারটা বলেছে ?
- হ্যাঁ বলেছে। আমার জন্য তোমার রেকমেন্ডেশনটা খুব ইম্পর্টেন্ট।
- দেখো জামিল ... আমি তোমার কাজে ইমপ্রেসড, তবে আমি এখনও রেকমেন্ড করার মতো ইমপ্রেসড না। তোমার সাথে আমার আজকে পর্যন্তই কাজ। কালকে সকালে আসমা আমাকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাবে। তাই তোমাকে আমি রেকমেন্ড করবো কি করবো না ডিপেন্ড করছে তোমার এখনকার কথাবার্তার উপরে।
- আমি বুঝতে পারছি। বলো, কি জানতে চাও। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে আমি তোমাকে সব তথ্য দিয়েছি। আর কি কি বিষয়ে আমার মতামত চাও বলো।
- জামিল, তুমি আমাকে যেসব বলেছো সেসব বইয়ের কথা, বা ইন্টারনেটে গুগল সার্চের কথা। আমি এসব ইতিহাস জানি। আমি জানতে চাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আজকের বাংলাদেশীদের অনুভূতি কি ... আর এই ইতিহাস থেকে তারা কি কি শিক্ষা নেয়, এসব।
জামিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, আমি যদি এখন ক্যামেরার সামনে এসব ব্যাপারে আমার সত্যিকারের মতামত দেই, তাহলে তোমার ডকুমেন্টারিতে বর্তমানের বাস্তব ঢুকে যাবে। তখন এই ডকুমেন্টারি কোনো গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের মেসেজ দিবে না, অন্য কোনো মেসেজ দিবে।
- সেটা হোক ... তবু তুমি আমাকে বলো। আজকে যেসব ইন্টারভিউ আমি করেছি, সেখানে আমার মনে হলো সবার মনে কোনো না কোনো একটা হতাশা আছে। রিকশাওয়ালা বলছে ভাষার ইতিহাস গর্বের ব্যাপার, কিন্তু দেশের অনেক সমস্যা আছে। একজন ছাত্র বলছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে দেশের রাজনীতিবিদরা কোনো শিক্ষা নিচ্ছে না। একজন পথচারী বলছে ভাষা আমাদের গর্ব, কিন্তু এই দেশের শত্রু এখনও দেশেই আছে। সন্তানের হাত ধরে হাঁটতে থাকা মা বলছে, এই দিবস আমাদের জন্য গর্বের, কিন্তু আমি জানি না আমাদের সন্তানরা এই গর্বকে ধরে রাখতে পারবে কি না। এদের সবার মনে এতো কিন্তু কেন ? এরা সবাই এতো ভয়ে আর অনিশ্চয়তায় আছে কেন ?
- ইলেনোরা, তুমি যাদের কথা বলছো, এরা এই দেশের খুব সাধারণ মানুষ। এরা জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত, এদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কাটে অনিশ্চয়তায়। তাই এদের জীবনের প্রতিটা অনুভূতি কিন্তু দিয়ে ভরা। ভাষা আন্দোলনের পজিটিভ স্পিরিট মাখানো যেসব কথাবার্তা তুমি খুঁজছো, সেসব পেতে হলে তোমাকে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী, বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, বা টক শো এক্সপার্টদের সাথে কথা বলতে হবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বললে তোমাকে এসব হতাশা আর কিন্তুভরা কথাবার্তাই শুনতে হবে।
ইলেনোরা অল্প হেসে বললো, তুমি কোন দলের ... সাধারণদের দলের, না অন্য দলের ?
- আমি যদি অন্য দলের হতাম, তাহলে তোমার সাথে সারাদিন রেকমেন্ডেশনের আশা নিয়ে ঘুরতাম না। আমি খুবই সাধারণ ... আমার কথাতেও হতাশা আর অনেকগুলো কিন্তু থাকে।
- জামিল ... আমি জানি তোমাদের দেশের অনেক সমস্যা আছে। দারিদ্র্য আছে, ক্ষুধা আছে, ইনকাম ইনএকুয়ালিটি আছে, করাপশন আছে ...। কিন্তু তাই বলে কি সাধারণদের মনে দেশের বা ভাষার গৌরবের ইতিহাস নিয়ে কোনো আনন্দ থাকবে না ?
- তোমার প্রশ্নের উত্তর তোমার প্রশ্নের মধ্যেই আছে। আমি এর সাথে আর কিছু যোগ করতে চাই না। আমাদের দেশের সমস্যা তোমার ডকুমেন্টারির বিষয় না। তবে তুমি যাদেরকে হতাশাগ্রস্ত বলছো, কালকে খুব ভোরে সেসব মানুষরাই পরিবার নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসবে। এরা সবাই মনে মনে শহীদদের জন্য দোয়া করবে। সারাদিনের অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে একবার হলেও নীরবে বুকভরা নিশ্বাস নিয়ে বাংলা ভাষার জন্য গর্ববোধ করবে। এদেরকে কোনো টিভি ফুটেজে দেখাবে না, এদের নামধাম পত্রিকাতে আসবে না। কিন্তু এর পরও এরা এসব করবে।
ইলেনোরা পানির গ্লাস নামিয়ে রেখে বললো, আর অন্যরা কি করবে ?
- অন্যরা আজকে রাত বারোটা থেকে আসবে। শহীদ মিনারে ফুল দিবে, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। ওদেরটা টিভিতে আসবে, পত্রিকায় আসবে। ওদের সাথে দলবল থাকবে, বড় ব্যানারে ওদের পরিচয় থাকবে। মাইকে ওদের নাম বলা হবে। ওদের ফুলের তোড়ায় বড় করে ওদের নাম লেখা থাকবে। সেসব ফুলের তোড়া দেখে মনে হবে শহীদদের থেকে ওদের গুরুত্বই বেশী। ওরা মনে মনে কি ভাববে সেটা আমি জানি না। আমি সাধারণদেরটা জানি। আমি জানি সাধারণদের ফুলের তোড়ায় কোনো নাম লেখা থাকে না। সাধারণরা সকালে শহীদ মিনারে এসে তাদের সারা বছরের হতাশা, দুঃখ, কষ্ট, অনিশ্চয়তা আর নির্যাতনের কথা একবারের জন্য ভুলে নতুন করে বাঁচার উদ্দীপনা নিবে। আমাদের ভাষার এই গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস থেকে তারা তাদের মতো করে শিক্ষা নিবে, প্রেরণা নিবে। তাদের দেয়া শ্রদ্ধান্জলী হবে শুদ্ধ, পবিত্র আর স্বতঃস্ফূর্ত। তাদের সেই চেতনাই ছিলো ভাষা আন্দোলনের সত্যিকারের চেতনা।
- জামিল, যেই দেশের সাধারণরা এতো শুদ্ধ চেতনায় ভাষা আর দেশের সম্মানকে বুকে ধরে রাখতে পারে, সেই দেশে এতো সমস্যা কেন ? তোমাদের ভাষা কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদে সাধারণরা আন্দোলন করে শহীদ হয়েছিলো। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ভাষা আন্দোলনের এমন গৌরবের ইতিহাস নেই। অথচ তোমাদের দেশে সাধারণরা এখন দুঃসহ জীবনযাপন করছে, আর এরা সমাজের প্রভাবশালীদের অনেক অবিচার সহ্য করে যাচ্ছে। এসবের বিরূদ্ধে কোনো আন্দোলন হচ্ছে না! এমন কেন হচ্ছে ?
জামিল থমথমে মুখে বললো, সেটা আমি জানি না। তবে এসব খুব সম্ভবত তোমার এই ডকুমেন্টারির কোনো বিষয় না।
ইলেনোরা হালকা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর ক্যামেরা অফ করে বললো, সাধারণদের কথাতো শুনলাম। তুমি কালকে কি করবে জামিল ?
- আমি তোমার রেকমেন্ডেশনের অপেক্ষা করবো।
- তোমার এই দেশ, এই সাধারণ মানুষ, আর ভাষা-সংস্কৃতির এই চেতনা ছেড়ে তুমি লন্ডনে চলে যেতে পারবে ? সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে ?
জামিল কিছু বললো না। ইলেনোরা আবার বললো, যদি তোমাকে বলা হয় তোমার জন্য একটা জীবন রেকমেন্ড করতে, তুমি কি ধরণের জীবন রেকমেন্ড করবে ?
- আমি সেটা জানি না ইলেনোরা। আমার সামনে অনেকগুলো বাস্তব সমস্যা আছে ... আমার কোনো চাকরী নেই, আমার বাবা বেঁচে নেই, সংসারে উপার্জনের কেউ নেই। আমার মা আর ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনার জন্য আমাকে উপার্জন করতে হবে। বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমার দেশের বাইরে চলে যাওয়াটা খুব প্রয়োজন।
- তাই জামিল! আমারতো মনে হয় তুমি বাংলাদেশে থেকেই এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে। যেই মানুষ দেশকে, দেশের ইতিহাসকে, আর দেশের মানুষকে এতো ভালোবাসতে পারে, তার জন্য তো এসব সাময়িক সমস্যা দেশে থেকেই সমাধান করা সম্ভব। তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ইতিহাস, আর বাংলাদেশের মানুষ। এতো সুন্দর ভালোবাসাগুলোকে ছেড়ে তুমি বিদেশে গিয়ে কিভাবে থাকবে জামিল ?
জামিল চুপ করে থাকলো। ওর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। মনের ভিতরে জমে থাকা অনেকগুলো আবেগ একসাথে সেই পানিতে গিয়ে মিশেছে।
ইলেনোরা অল্প হেসে বললো, তোমার কাছে আমার প্রশ্নের উত্তর আছে জামিল ... কিন্তু তুমি উত্তরটা দিতে ভয় পাচ্ছো, দ্বিধাবোধ করছো। কারণ তুমি নিজেও তোমার দেশ আর দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাও না। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে রাখা একটা নামবিহীন ফুলের তোড়ায় ভাষা শহীদদের প্রতি তোমাদের সাধারণদের যেই প্রার্থনা আছে, তোমার জীবনের কাছে এই মুহূর্তে তোমার তেমনই কোনো যাচনা আছে। তাই আমি যদি তোমাকে এখন রেকমেন্ড করি, তুমি তোমার একটা পাওয়ার বদলে অনেক কিছুই হারাবে।
জামিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, তুমি ঠিক বলেছো ইলেনোরা। তোমার রেকমেন্ডেশনে জীবনে আমি একটা কিছু হয়তো পাবো, কিন্তু তার বদলে হারাবো অনেক কিছু।
ইলেনোরা জামিলের দিকে তাকিয়ে হাসলো। খুব অদ্ভূত মিষ্টি হাসি। ওর হাসিতে একটা মায়াভরা আবেশ আছে। সেই আবেশে থাকা অবস্হায় যে কোনো কথাকে মনেপ্রাণে মেনে নেয়া যায়।
ইলেনোরা জামিলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো, তোমার সাথে ভবিষ্যতে কাজ করতে আমারই আগ্রহ বেশী, কিন্তু সরি জামিল .... আমি তোমাকে রেকমেন্ড করতে পারছি না। তোমার নামবিহীন ফুলের তোড়ার কথাটা মনের ভিতরে কেন জানি একটা অজানা কষ্ট দিয়ে গেছে। আমি সেই অজানা কষ্টটাকে আমার সাথেই রাখতে চাই ...... আমি সবসময় ভাবতে চাই যে বাংলাদেশে আমার এমন একটা বন্ধু আছে যে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে লাখো সাধারণের সাথে গিয়ে নামবিহীন একটা ফুলের তোড়া শহীদ মিনারে রেখে আসে, আর একবুক নিশ্বাস নিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের জন্য নীরবে গর্ববোধ করে। এরপর সে আবার নির্ভয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে যায়।
জামিল অনেকক্ষণ পরে হাসলো। ইলেনোরার হাসিমুখে বলা সেই অজানা কষ্টের কথা শুনে ওর খুব ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে সেটা অবশ্য ওর জানা নেই।